সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরও জিয়া ও এরশাদের প্রেতাত্মা থেকে গোটা দেশ ও জাতি আজও মুক্ত হতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। গতকাল শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ওই ঐক্য পরিষদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। রানা দাশগুপ্ত বলেন, বিগত ১৩ বছরে দেশের উন্নতি হয়েছে এটি ঠিক তবে জনগণের মানস গঠন অনেক দূর পিছিয়ে গেছে। অস্বীকারের উপায় নেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাঙালিত্বের পরিচয় নয়, ধর্মীয় পরিচয় আজ ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে, রাজনৈতিকজীবনে, রাষ্ট্রজীবনে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকটটি এখানেই। এ সংকট থেকে উত্তরণে ৭২-র সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে আমরা অধিকতর শানিত করতে হবে। নতুবা বিপর্যয় অনিবার্য। মনে রাখতে হবে এ বিপর্যয়ের জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রক্তার্জিত এ বাংলাদেশ উল্টোপথে চলতে শুরু করে উল্লেখ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাস গুপ্ত বলেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে পাকিস্তানী সংবিধানের অনুরূপ সংবিধানে রূপান্তর করে। তিনি আরও বলেন, একই ধারায় পরবর্তী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালে বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্নের জন্যে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে তৎকালীন পার্লামেন্টে বিল উত্থাপনের প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে পরিচালনার আকাক্সক্ষায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্যে আমরা বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুক্তিযুদ্ধ করিনি। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি এ সংগঠন গঠনে আমাদের বাধ্য করেছে। এটি আপামর বাঙালি জাতির জন্যে লজ্জার। এ বিল উত্থাপনের দুই দিন পর ১৯৮৮ সালের ২২ মে যেদিন পার্লামেন্টে এ বিল নিয়ে আলোচনা শুরুর কথা ছিল সেদিনই ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে অনেকেই উপস্থিত জানিয়ে তিনি বলেন, জন্মসূত্রের পরিবর্তে ধর্মসূত্রে প্রাপ্ত বিশেষ নাগরিক অধিকার গোটা জাতির সার্বিক অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানবে বলেই সেদিন আমরা আশঙ্কা করেছিলাম। ৩৪ বছর পরে এসেও আমাদের কাছে মনে হয় এ আশঙ্কা থেকেই গেছে। প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, তাজউদ্দীনসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার উপেক্ষার স্বীকার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুও উপেক্ষা শিকার হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের কষ্টের কথা পাঠ্যপুস্তকে আসে না, চুকনগর গণহত্যার কথা পাঠ্যপুস্তকে আসে না। পাঠ্যপুস্তকে হেফাজত দখল নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা- মুক্তিযুদ্ধের হত্যাকা-। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধে পারেনি, কিন্তু পরে পাকিস্তানপন্থিরা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্যে ফেরত চাই। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সংগঠন করার অধিকার সব নাগরিকের আছে। কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতো সংগঠন করতে হলে সেটা আমাদের লজ্জা নয়, এই রাষ্ট্রের জন্য লজ্জা। নতুন প্রজন্মকে সংগ্রামের জন্য তৈরি করতে হবে। কোন বাংলাদেশ, কেমন বাংলাদেশ আমরা প্রত্যাশা করি তা তাদের বোঝাতে হবে। ৫০ বছরে আমরা অন্তত একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু তা থেকে এখনো কত দূরে আমরা। দেশের একজন নাগরিক সাম্য, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে আছেন এই কথা কি জোর গলায় বলতে পারি? যদি না পারি তাহলে বুঝতে হবে, রাষ্ট্রের কোথাও একটা গলদ আছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভাপতি রেখা চৌধুরী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিওসহ প্রমুখ।
জাল স্ট্যাম্প বিক্রির হোতাসহ গ্রেপ্তার ৪
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে অবৈধ জাল জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এবং কোর্ট ফি তৈরির জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা ফরমান আলী সরকারসহ (৬০) চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জাল জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার ও কোর্ট ফি স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার বাকি তিনজন হলেন- মো. তুহিন খান (৩২), মো. আশরাফুল ইসলাম (২৪) ও মো. রাসেল (৪০)। র্যাবের মতে, বৈধ ও অবৈধ স্ট্যাম্পের পার্থক্য করা খুবই কঠিন। এসব অবৈধ স্ট্যাম্প তৈরির ফলে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে, এসব অবৈধ স্ট্যাম্প গ্রহণের ফলে সেবাগ্রহীতাদের সম্পদ-সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়ছে। গতকাল শনিবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফট্যানেন্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সম্প্রতি র্যাব-৩ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, একটি অসাধু চক্র দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় বেশি লাভের আশায় জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রতারণামূলকভাবে জনসাধারণের কাছে বিক্রি করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার র্যাব-৩ ও এনএসআইয়ের যৌথ আভিযানিক দল মতিঝিলে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে বিপুল পরিমাণ জাল স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়। অভিযানে জব্দ হওয়া নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প: ১০০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬ হাজার ৫০০টি, ৫০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৩ হাজারটি, ৩০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৪০০টি, ২৫ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৫০০টি, ২০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৪ হাজারটি, ১০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ২ হাজার ৫০০টি, ৫ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬ হাজার ৫০০টি, ২ টাকা মূল্যমানের অনুলিপি স্ট্যাম্প ১ হাজার ৫০০টি। জব্দ হওয়া রাজস্ব স্ট্যাম্প: ৫০০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ২০০টি, ১০০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৩ হাজার ৬৪০টি, ৫০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৪ হাজার ২০০টি, ২৫ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১৬০টি, ২০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৩ হাজার ৭২০টি, ১০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১১ হাজার ২৮০টি, ৫ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১৪ হাজার ২৮০টি, ৪ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ২৪০টি ও ২ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৪৮০টি। মোট ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫২০ টাকা মূলমানের ৩৮ হাজার ২০০টি রাজস্ব স্ট্যাম্প এ সময় জব্দ করা হয়। উদ্ধারকৃত সব স্ট্যাম্পের মোট মূল্য ১৯ লাখ ৩ হাজার ৫২০ টাকা। এ সময় কার্টিজ পেপার ৫ হাজারটি, মনিটর একটি, সিপিইউ একটি, প্রিন্টার একটি ও নগদ ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬০ টাকা জব্দ করা হয়। জালিয়াতি চক্রের কর্মকা-ের ব্যাপারে র?্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা ফরমান আলী সরকার নিজেকে ভেন্ডার হিসেবে পরিচয় দিলেও তার কাছে থাকা স্ট্যাম্প সম্পর্কে সে সঠিক হিসাব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এসব স্ট্যাম্প তৈরি অথবা সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে প্রতারণার মাধ্যমে আসল হিসেবে বিক্রি করতো সে। জব্দ হওয়া স্ট্যাম্পগুলোর কাগজ ও মুদ্রণ সঠিক নয়। এগুলো ছিদ্রবিহীন ও পেছনে আঠালো প্রলেপের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এসব স্ট্যাম্প নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যযুক্ত নয়। গ্রেপ্তাররা কোনো ট্রেজারি চালান দেখাতে পারেনি। গ্রেপ্তার তুহিন খান ও রাসেল আর্থিক লাভের আশায় এসব অবৈধ জাল স্ট্যাম্প মতিঝিলের বিভিন্ন ভ্রাম্যমান দোকানে বিক্রি করতো। তারা প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর ধরে এই প্রতারণা ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তারদের বিষয়ে কর্নেল মহিউদ্দিন বলেন, গ্রেপ্তার ফরমান আলী কুড়িগ্রাম সরকারি ডিগ্রী কলেজ হতে ডিগ্রী পাস করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে স্ট্যাম্প ভেন্ডারের ব্যবসায় লিপ্ত হন তিনি। তার বিরুদ্ধে এর আগেও সিআইডির কাছে একই কাজের জন্য মামলা হয়। সেই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার ও জেলহাজতে ছিলেন। বর্তমানে তিনি জামিনে থাকায় ওই মামলায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। গ্রেপ্তার মো. তুহিন খান রাজধানীর শনির আখড়া মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এ ছাড়া মো. আশরাফুল ইসলাম পুটিকাটা সিন্দুরমতি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তিনি এর আগে গ্রামীনফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গ্রেপ্তার মো. রাসেল কোনাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় ২০১২ সালে একটি অস্ত্র আইন ও একটি অপহরণের মামলা রয়েছে। যেসব ভেন্ডর জাল স্ট্যাম্প নিয়েছে তাদের তালিকা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, কিছু তালিকা আমরা পেয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে র্যাব-৩ ও এনএসআইয়ের গোয়েন্দারা নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। তারা এই জাল স্ট্যাম্প কোথা থেকে প্রিন্ট করতেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে তারা প্রিন্টিংয়ের কাজ করতো। তবে অভিযানের জন্য আপাতত আমরা সেই ঠিকানা বলতে চাচ্ছি না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যাদেরকে গ্রেপ্তার করেছি তাদের কাছে কোনো লাইসেন্স ছিল না। তবে লাইসেন্সধারী বৈধ ভেন্ডাররাও জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করে। তারা এক লাখ টাকার বৈধ স্ট্যাম্পের সঙ্গে আরও ১০ লাখ টাকার অবৈধ স্ট্যাম্প রাখছে।
জিয়া-এরশাদের প্রেতাত্মা থেকে জাতি মুক্ত হতে পারেনি: রানা দাশগুপ্ত
আরও খবর