শনিবার, জুন ৩, ২০২৩
Homeপ্রধান সংবাদলকডাউনের অভিশাপে আর পড়তে চায় না দেশের মানুষ

লকডাউনের অভিশাপে আর পড়তে চায় না দেশের মানুষ

বিশ্ব অতিক্রম করছে একটি দুর্যোগকাল। দীর্ঘ দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে করোনা মহামারীর কবলে বিশ্ব আজ নাজেহাল। বাংলাদেশে করোনা আঘাত হানে ২০২০ সালের মার্চ মাসে। এরপর দেশটিকে বিভিন্ন সময়ে লকডাউন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। লকডাউন অবস্থায় প্রায় বলতে গেলে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা সবকিছুই অচল হয়ে যায় একপ্রকার। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাক্ষেত্র। এই ক্ষতি অপূরণীয়।
সম্প্রতি করোনা মহামারীর নতুন ধরণ ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করতে ধরেছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এমতাবস্থায় লকডাউন শঙ্কায় ভুগছে গোটা দেশবাসী। তবে বিশেষজ্ঞরা নতুনভাবে লকডাউন না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, করোনা মোকাবিলায় ফের লকডাউন নয়, বরং কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন জরুরি। এর আগে পরপর দুই দফা লকডাউনে দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে। আগের সেই ধাক্কা সামলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যাংকিং খাত থেকে দেওয়া প্রণোদনার ঋণের অর্থ পরিশোধের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মোকাবিলায় আর লকডাউন নয়, মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রেখে কঠোর বিধিনিষেধ নিশ্চিত করতে হবে।
একটু একটু কসেরে উঠতে ধরা অর্থনীতি লকডাউনের কবলে পড়লে যে আবার করুণ দশার সৃষ্টি হবে তাতে কন সন্দেহ নেই। কাজেই লকডাউন না দিয়ে বিশেষ করে সবার জন্য টিকা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাস্ক পরিধান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ হাত ধোয়া, হাসপাতালের সক্ষমতা ও সেবার মান বাড়ানো এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা বাধ্যতামূলক করাকেই শ্রেয় মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা নতুন করে লকডাউন দেওয়া হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। শত শত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। দেউলিয়া হবেন উদ্যোক্তারা। বেকারত্ব আরও বাড়বে। পঙ্গু হবে ব্যাংকিং খাত।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ১১ মাস দেশ কার্যত অচল ছিল। এ অবস্থায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের ফলে ইউরোপে দু-একটি দেশে এবং ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশেও লকডাউনের বিষয়টি সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ও শিক্ষা খাত। দুই দফায় করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এসব প্রণোদনার বেশির ভাগই ঋণনির্ভর। এর মধ্যে কয়েকটি খাতে ঋণ পরিশোধের সময় শেষ হলেও শিল্প খাতের সক্ষমতা বিবেচনায় সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
লকডাউনের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব এখনো চলছে। লকডাউনের কারণে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তা এখনো সামলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতে দু-একটি খাতে কিছুটা সম্ভাবনা দেখা গেছে। বিশেষ করে রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। ফলে এই অবস্থায় লকডাউন দেওয়া হলে তা নেতিবাচক হবে। দীর্ঘ মেয়াদে এর মূল্য দিতে হবে। সবকিছু বিবেচনায় নতুন করে লকডাউন দেওয়া যৌক্তিক নয়। এবার করোনা বাড়লেও মৃত্যুর হার কম। এটি ইতিবাচক দিক। ফলে লকডাউন না দিয়ে সবাই যাতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসানের ভাষ্য, করোনা বাড়ছে; কিন্তু লকডাউনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। পাশাপাশি অর্থনীতির সক্ষমতাও কমেছে। আর লকডাউন কোনোভাবেই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক নয়। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, জীবন-জীবিকার যে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে, লকডাউনের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এ ধরনের সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত নয়। বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধির দিকে জোর দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও কঠোর বিধি আরোপ এবং সেটি মানতে বাধ্য করতে হবে। তার মতে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ সবাইকে টিকা দেওয়া হলে ক্ষতি কমে আসবে।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে কভিড রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শনাক্তের হার প্রায় ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া না হওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা। তবে উদ্বেগ বাড়লেও এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে না বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু আছে, সেভাবে পাঠদান অব্যাহত থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করবে।
উল্লেখ্য, দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ৫৪৩ দিন পর গত ১২ সেপ্টেম্বর আবার শ্রেণীকক্ষে ফেরে শিক্ষার্থীরা। এরইমধ্যে গত নভেম্বরে নভেল করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশেও ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে।
এতে কন সন্দেহ নেই যে, লকডাউন দিলে প্রায় ভেঙ্গে পড়া শিক্ষাখাত যে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে চলে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে বিশ্বে করোনার যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট যখন ধরা পড়ছে, বাংলাদেশে তার প্রকোপও বাড়ছে। তবে রোগটি প্রতিরোধে সবাইকে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা জরুরি। টিকা এবং স্বাস্থ্য একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পৃক্ত। ফলে সমন্বিতভাবে দুটিই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে না ছড়ানো এবং প্রাণহানি না হলে তড়িঘড়ি করে লকডাউন যৌক্তিক নয়। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।
এই মুহূর্তে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। এই মুহুর্তে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

আরও খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

সাম্প্রতিক খবর

সর্বাধিক পঠিত

- Advertisment - spot_img